বিশ্বনবী সা. এর নবুওয়তি মিশন-মানবতার শান্তি ও মুক্তির পথ




ধরাধামে বিশ্বনবীর (সা.) শুভাগমন মানবতার প্রতি আল্লাহর অপার অনুগ্রহ
আল্লাহপাক বলেন:
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
অর্থ: প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অতি বড় অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল পাঠিয়েছেনযিনি তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেনযদিও এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল। (সূরা আলে ইমরান: ১৬৪)
মানুষ আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিআর মানুষের মধ্যে মর্যাদার বিচারে সর্ব
 শ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় হচ্ছেন নবী-রাসূলগণঅথচ এই নবী-রাসূলগণের দুনিয়ার যাপিত জীবন ছিল
সর্বাধিক যন্ত্রণাময়, অতিশয় দুঃখময়তাঁদের কেউ এর ব্যতিক্রম ছিলেন নাহাদীস শরীফে এসেছে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মানুষের মধ্যে সর্বাধিক বিপদগ্রস্থ আম্বিয়াগণএরপর যারা শ্রেষ্ঠতর (শ্রেষ্ঠত্বে আম্বিয়াগণের নিকটবর্তী) এর পর যারা শ্রেষ্ঠতর। (সুনানে তিরমিজি, হাদীস: ৯৯২) আবার নবী-রাসূলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন, আমাদের প্রিয় নবী, বিশ্বনবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতাঁর মর্যাদার সাথে অন্য কারো মর্যাদার তুলনা হয় নাতিনি আল্লাহপাকের কত প্রিয় ছিলেন, তা আমাদের অনুভব-উপলব্ধিরও ঊর্ধ্বেএসব সত্ত্বেও তাঁকে দুনিয়ার জীবনে এতো যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল, যা আর কাউকে করতে হয়নিহাদীস শরীফে এসেছে, রাসূল সা. বলেন, আমাকে এতো অধিক আতঙ্কগ্রস্থ করা হয়েছে, যা আর কাউকে করা হয়নিএবং আমাকে আল্লাহর পথে এতো অধিক কষ্ট প্রদান করা হয়েছে, যা আর কাউকে প্রদান করা হয়নি। (শামায়েলে তিরমিযি, হাদীস: ৩৬৭)
এখানে একটি প্রশ্ন যে কারো অন্তরকে আলোড়িত করবেএ কষ্টের জগতে আল্লাহপাক নবীজি সা.কে কেন পাঠিয়েছিলেনকেনইবা তাঁকে দুনিয়ার যে কোনো বাসিন্দার তুলনায় সর্বাধিক কষ্টের জীবন যাপন করতে হয়েছিলএ প্রশ্নের জবাব দিয়েই আল্লাহপাক আয়াতখানা শুরু করেছেনআমি আমার প্রিয় হাবীবকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছি, বিশ্বাসী নারী-পুরুষের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করার জন্যতাদের কপাল খুলে দেয়ার জন্যঈমানদারদের প্রতি এটি আমার বিশেষ করুণা

নবীজি সা. মানুষ ছিলেন, তবে সাধারণ মানুষ নন
আমাদের আলোচ্য আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেনতিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল পাঠিয়েছেনতাদেরই মধ্য হতে ’’ এর ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসীর রহ. লিখেনÑতাদের স্বজাতীয় মানব সম্প্রদায় থেকে, যেন তারা তাঁকে সহজে সম্বোধন করতে, প্রয়োজনীয় বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে, একসঙ্গে উঠা-বসা করতে সক্ষম হয়আর এসব প্রয়োজন নবীর কাছ থেকে দ্বীনকে পরিপূর্ণরূপে বুঝে নেয়ার স্বার্থে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫২১) আমাদের সমাজে মাঝে-মধ্যে এমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা নবীজি সা.কে মানুষ বলতে নারাজতাদের ভাষায় নবীজি মানবোর্ধ্বতাদের বিশ্বাস মতে কেউ নবীজিকে মানব বললে সে ঈমান হারা হয়ে যায়কুরআন-হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতাই এহেন ভুল আকিদা-বিশ্বাসের মূল কারণনবীজি সা. যে মানুষ ছিলেন তা কুরআন-হাদীসের অনেক স্থানে স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হয়েছেসূরা কাহাফের ১১০, সূরা ফুরকানের ৭ ও ২০, সূরা ইউসূফের ১০৯ সূরা নাহলের ২৩ ও সূরা আম্বিয়ার ৭নং আয়াত এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য

শান্তিময় পৃথিবী গড়তে বিশ্বনবী সা.এর নবুওয়তি মিশন
জগতবাসীর হেদায়াত, পরিবর্তন ও সংশোধনের লক্ষ্যে আল্লাহপাক নবীজি সা.কে চারটি মৌলিক দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেনযেমনটি আলোচ্য আয়াতে উল্লিখিত হয়েছেএই একই বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে কুরআনে কারীমের আরো তিন জায়গায়সূরা বাকারা, আয়াত ১২৯ ও ১৫১ এবং সূরা জুমআ আয়াত ২দায়িত্ব চারটি হচ্ছে, এক. কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত, দুই. তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি, তিন. কুরআনে কারীমের তালীম, চার. হিকমতের তালীমনবীজি সা.এর এই চার দায়িত্বই ছিলো মূলত তাঁর নবুয়তি মিশন যার সফল বাস্তবায়ন মানব সমাজকে আমূল বদলে দিয়েছিলোজাহিলিয়াতের যুগকে স্বর্ণযুগে পরিণত করেছিলোবর্বর ও ইতর প্রকৃতির লোকগুলোকে চারিত্রিক উৎকর্ষের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিয়েছিলোতৈরী হয়েছিলো আবু বকর, উমর, উসমান ও আলীনক্ষত্রতুল্য লক্ষাধিক সাহাবীরিদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাইন
এমন সমাজ তৈরী হয়েছিল যেখানে হিংসা-প্রতিহিংসা ছিলো নাশত্রুতা-পরশ্রিকাতরতা ছিলো নাছিলো না অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণের হীন মানসিকতা, দুর্বলের প্রতি সবলের নির্মম অত্যাচারের মহড়াসমাজের প্রতিটি মানুষের অন্তরে ছিলো পরোপকারের উচ্চ মানসিকতা, অতুলনীয় উদারতা ও অপরিসীম মহানুভবতাপারস্পরিক সহাবস্থানে সবলেরা দুর্বলের জন্য ছায়া ছিলোনেতৃত্বের অধিকারীরা আত্মোৎসর্গকারী নিরহংকার সেবক ছিলোসমাজের আমীর-গরীব, সবল-দুর্বল নির্বিশেষে সকলেই যখন সত্যিকার মানুষে পরিণত হয়েছিলো, সমাজ তখন শান্তির আধারে রূপান্তরিত হয়োছিলোনবুওয়তি মিশনের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা নিম্নে পেশ করছি
এক. কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত
নবুওয়তি মিশনের প্রথম দায়িত্ব ছিলো কুরআন মাজীদের তিলাওয়াতমানুষের জীবনে সংশোধন ও পরিবর্তন সাধনে তিলাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীমএ কারণে এটির কথা প্রথমে এসেছেআমাদের বর্তমান সমাজে কুরআনের তিলাওয়াত চরমভাবে উপেক্ষিতঅনেকেই তো মোটেই তিলায়াত করতে জানেন না বা শুদ্ধ করে পড়তে পারেন নাআর যারা তিলায়াত করতে জানেন, তাদের মধ্যেও নিয়মিত তিলাওয়াতকারীর সংখ্যা নিতান্তই কমসীমিত সংখ্যক তিলাওয়াতকারী যারা রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগের তিলাওয়াতও অপূর্ণাঙ্গহক আদায় করে তিলাওয়াত তাদেরও হয় নাশুধু পড়ে যাওয়ার দায়টুকু সারেনহক আদায় করে তিলাওয়াতই হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ তিলাওয়াততিলাওয়াতের হক হচ্ছে তিনটিএক. আয়াতগুলো পড়ে যাওয়া, দুই. পঠিত আয়াতগুলোর অর্থ ও মর্ম বুঝা, (কুরআনের অর্থ ও মর্ম বুঝার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা পরে আসছে) তিন. পঠিত আয়াতগুলোর নির্দেশনা মোতাবেক আমল করা। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন: ১/৩২৩)আল্লাহপাক বলেন,
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلاوَتِهِ أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ
অর্থ: আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা এর হক আদায় করে তিলাওয়াত করেআর সত্যিকার অর্থে তাঁরাই কিতাবের উপর ঈমান এনেছে। (সূরা বাকারা: ১২১) চিকিৎসা যথার্থরূপে না হলে যেমন পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভ করা যায় না, তেমনি তিলাওয়াতও হক আদায় করে না হলে এর দ্বারা ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনের পরিপূর্ণ সুফল অর্জিত হয় না
অর্থ না বুঝে তিলাওয়াতেও সাওয়াব হয়
উপর্যুক্ত আলোচনার উদ্দেশ্য এই নয় যে, অর্থ না-বুঝে তিলাওয়াত করলে সাওয়াব হবে নাআজকাল কিছু মানুষ কুরআনকে মানব রচিত বই-পুস্তকের সাথে তুলনা করে বলতে চায়, অর্থ ও ব্যাখ্যা না বুঝে কুরআনের শব্দ-বাক্য পড়া ও পড়ানো নিছক সময় নষ্ট করাতাদের এ কথা জানা নেই যে, আল্লাহর কালামকে মানুষের রচিত গ্রন্থের সাথে তুলনা করা অন্যায়শব্দ এবং অর্থ উভয়টা মিলে কুরআনঅর্থ বুঝে বর্ণিত বিধানাবলীর উপর আমল করা যেমন ফরজ এবং সর্বোচ্চ ইবাদত, তেমনি এর শব্দ-বাক্যকে পাঠ করাও আলাদা একটি ইবাদতকুরআনের প্রতিটি শব্দের প্রভাব মানুষের অন্তরে পড়ে এবং অন্তরকে প্রভাবিত করেএ ক্ষুদ্র নিবদ্ধে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন: ১/৩২৩)
দুই.তাযকিয়াহ্ বা আত্মশুদ্ধি
নবুওয়তি মিশনের দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিলো তাযকিয়াহ্ অর্থাৎ উম্মতের অন্তরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করাঅন্তরের পরিশুদ্ধি প্রত্যেকের উপর ফরজএর গুরুত্ব অপরিসীমসূরা আশশামসে আল্লাহপাক এগারটি বস্তুর কসম করে বলেছেন-
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا - وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا
অর্থ: সাফল্য লাভ করেছে ঐ ব্যক্তি যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করেছে, আর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে ঐ ব্যক্তি যে অন্তরকে কলুষযুক্ত করেছে। (সূরা আশ-শামস: ৯-১০)
তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি বলতে কী বুঝায় এবং তা অর্জন করার সঠিক পদ্ধতি কী, এ ব্যাপারে আমাদের সময়ের অনেক মুসলমানই অজ্ঞআর এ অজ্ঞতাকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর পীর দাবীদার ভন্ডরা স্থানে-স্থানে খানকা গড়ে তুলে সরলমনা মুসলমানকে প্রতারিত করছেওরা আত্মশুদ্ধির নামে নিজেদের উদ্ভাবিত পথ ও পন্থা অবলম্বন করে শরীয়তের সীমারেখা লঙ্ঘন করছেশরীয়তের ফরজকে ফরজ স্বীকার করছে না, শরীয়তের হারামকে হারাম মনে করছে নাওদের নামাজ, রোজা, হজ্জ, জাকাতের প্রয়োজন হয় নাপর্দা পালন করতে হয় নামদ-গাঁজা বর্জন করতে হয় নাআত্মশুদ্ধির নাম করে এসব ভন্ডরা দিন-দিন সরলপ্রাণ ঈমানদারদের অন্তরের কলুষকে বৃদ্ধি করে ভ্রষ্টতার চরম সীমায় পৌঁছে দিচ্ছে
আত্মশুদ্ধির দ্বারা উদ্দেশ্য, আত্মাকে পবিত্র করা এবং পবিত্র রাখাঅন্তর অপবিত্র হয় গোনাহের দ্বারাআল্লাহর হক নষ্ট করার গোনাহ ও বান্দার হক নষ্ট করার গোনাহযে ব্যক্তি কৃত গোনাহের জন্য খাঁটি মনে তাওবা করেছে, সে তার অন্তরকে অতীতের গোনাহ থেকে পবিত্র করে নিয়েছেআল্লাহর হক সম্পর্কিত গোনাহ থেকে তাওবা করার জন্য শর্ত হচ্ছে তিনটিএক. কৃত গোনাহের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়াদুই. গোনাহ ছেড়ে দেওয়া, কেননা গোনাহে লিপ্ত থেকে তাওবা করা আল্লাহর সাথে বিদ্রুপ করার নামান্তরযেমন, কেউ সুদের গোনাহে লিপ্ত থাকলে, তাকে প্রথমে সুদী লেনদেন বর্জন করতে হবে, অতপর তাওবা করতে হবেতিন. ভবিষ্যতে গোনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করাপরবর্তী সময়ে গোনাহে লিপ্ত হওয়ার নিয়ত যদি অন্তরে থাকে, তাহলে এমন তাওবা অর্থহীননিয়ত করতে হবে ভবিষ্যতে গোনাহ না করার এবং এই মর্মে মজবুত প্রতিজ্ঞা করতে হবেএরপরেও যদি সংকল্প ভঙ্গ হয়ে যায়, এতে তাওবার কোনো ক্ষতি নেইআবার শর্ত পূরণ করে তাওবা করে নিলেই চলবেআর যদি গোনাহটি বান্দার হক সম্পর্কিত হয়, তাহলে চতুর্থ একটি শর্ত যোগ হবেবান্দার হক আদায় করে দেওয়া কিংবা তার থেকে মাফ করিয়ে নেওয়া। (রিয়াজুস সালেহীন: ১০)
তাওবার পাশাপাশি তাকওয়াও অবলম্বন করতে হবেতাকওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্তরে আল্লাহতালার এতটুকুন ভয় জাগ্রত রাখা যেন গোনাহ করার হিম্মত না হয়চাই আল্লাহর হক সম্পর্কিত গোনাহ হোক কিংবা বান্দার হক সম্পর্কিত গোনাহতাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির শায়খ বা পীর যিনি হবেন, তিনি মুরীদকে তাওবা ও তাকওয়া অবলম্বের মাধ্যমে নিজ অন্তরকে গোনাহমুক্ত রাখার অভ্যস্থ বানাবেন আরো সহজ করে বলা যায় যে, তিনি আপন মুরীদকে শরীয়তের করণীয় কাজগুলো করার এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো বর্জনের তালীম দিবেনইমাম ইবনে কাসীর রহ. বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.এর তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধির পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছেনÑ
يأمرهم بالمعروف وينهاهم عن المنكر لتزكُوَ نفوسهم وتطهر من الدَّنَسِ والخَبَث
অর্থ: তাদেরকে সৎকাজের আদেশ করতেন এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করতেনযেন তাদের অন্তর পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পুত-পবিত্র থাকে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর: ১/৫২১)

পীর-মাশায়েখের জিকির-ওজিফা কখনই শরীয়তের বিধানাবলীর বিকল্প হতে পারে নাসেগুলোকে ভিটামিন ওষুধের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারেযা দুর্বল শরীরকে সাময়িকভাবে সবল করে এবং শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেকোনো বোকাও ভিটামিন খায় বলে স্বাভাবিক পানাহারকে বর্জন করে নাঠিক তেমনি হক্কানী পীরদের বাতানো জিকির-ওজিফা দুর্বল আত্মাকে সবল করে এবং তাকওয়ার শক্তিকে বৃদ্ধি করেফলে শরীয়তের বিধানাবলী পালন করা তার কাছে কঠিন বলে মনে হয় নাবরং সহজ হয়ে যায়, এতে এক প্রকার মজা অনুভব করেসুতরাং এসব জিকির-ওজিফা শরীয়তের বিধানাবলীর সহায়ক, বিকল্প কিছু নয়
তিন. কুরআনে কারীমের তালীম
আল্লাহপাক কুরআন নাজিল করেছেন বিশ্বমানবতার শান্তি-সফলতার সফল জীবন ব্যবস্থা হিসেবেমানব জীবনের ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রের পূর্ণাঙ্গ দিক-নির্দেশনা আল্লাহর কালামে বিদ্যমানজীবনের প্রতিটি অঙ্গনে কুরআনের নির্দেশনা গ্রহণের পূর্বশর্ত হচ্ছে, এর অর্থ-ব্যাখ্যা যথার্থরূপে জানা, বুঝা ও উপলব্ধি করাআর এর জন্য আবশ্যক হলো মুয়াল্লিম বা শিক্ষকের তালীমরাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেন- আমি মুয়াল্লিম বা শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি কেবল ভাষাজ্ঞান দ্বারা কুরআনের অর্থ-মর্ম কেউ সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হয় নাস্বয়ং বিশ্বনবী সা. তালীমের মুখাপেক্ষি ছিলেনএবং নবীজি সা. কে তালীম দানকারী ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলাআল্লাহপাক বলেন-
অর্থ: তারপর তার (কুরআনের) বিশদ ব্যাখ্যা শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্বও আমারই। (সূরা কিয়ামাহ: ১৯)

আজকাল অনেক মানুষ এমন রয়েছেন, যারা ঘরে বসে বঙ্গানুবাদ পড়ে কুরআন বুঝার দাবী করছেনএমনকি অনেক বিষয়ে আলেমদেরকে চ্যালেঞ্জ করছেনচিকিৎসা বিদ্যার বইগুলো নিজে-নিজে পড়ে কেউ চিকিৎসা শাস্ত্র আয়ত্ব করতে পারে নাবরং শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হয়প্রকৌশল বিদ্যার গ্রন্থাবলী ঘরে বসে পড়ে কেউ প্রকৌশলী হতে যেতে পারে না, বরং তাকে শিক্ষক ও শিক্ষালয়ের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়এসব দৃষ্টান্ত আমরা সবাই জানিতাহলে ইলমে ওহীর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে কীভাবেএহেন চিন্তা অনেকের গোমরাহীর কারণ হয়। (দ্রষ্টব্য: তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন: ১/৩২৪) এ আলোচনার দ্বারা উদ্দেশ্য এই নয় যে, বাংলায় অনুদিত কোনো তাফসীর পড়া যাবে নাঅবশ্যই পড়া যাবে, তবে তা হতে হবে কোনো বিজ্ঞ আলেমের তত্ত্বাবধানেকিতাব সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরীকেননা আজকাল বাজারে অনির্ভরযোগ্য কিতাবের সংখ্যাও কম নয়
চার. হিকমতের তালীম
হিকমতের আভিধানিক অর্থ প্রজ্ঞা, বিজ্ঞতা হলেও মুফাসসীরিনে কেরাম এখানে হিকমতের তাফসীর করেছেন সুন্নত দ্বারাএ তাফসীর যথার্থকেননা, নবীজি সা.এর প্রতিটি সুন্নতই ছিল সর্বোচ্চ হিকমত ও প্রজ্ঞাপূর্ণপ্রতিটি সুন্নতেই রয়েছে জাগতিক ও পরলৌলিক প্রভুত কল্যাণদৃষ্টান্ত হিসেবে একটি সুন্নতের কথাই উল্লেখ করছিরাসূলে কারীম সা. ঘরে অবস্থানকালে ঘরোয়া কাজে স্ত্রীকে সহায়তা করতেনএটি একটি ছোট সুন্নতকেউ যদি এই সুন্নতটির উপরও আন্তরিকতার সাথে আমল করে, তাহলে এর সুফল দ্বারা তার পুরো দাম্পত্য জীবন প্রভাবিত হতে পারেস্ত্রীর কাজে স্বামীর সামান্য অংশগ্রহণ, যদি তা স্বতস্ফূর্তভাবে হয়, তাহলে সুন্নত পালনের সাওয়াব ছাড়াও এর নগদ প্রাপ্তি এই হবে যে, স্ত্রীর অন্তরে স্বামীর প্রতি ভালবাসায় এক নতুন মাত্রা যোগ হবেযা হয়তো দামী একটি উপহারের দ্বারাও হতো নাদাম্পত্য জীবনের শান্তি-সুখ নির্ভর করে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মুহাব্বত ও ভালবাসার উপরএখানে ভালবাসা যত বেশি হবে জীবন তত মধুর হবেইসলামে বিবাহ-ব্যবস্থার বৈধতা মূলত এমন মধুময় দাম্পত্য জীবন লাভের উদ্দেশ্যেইআল্লাহপাক বলেন:-
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً
অর্থ: তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ কর এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেননিশ্চয়ই এর ভেতর নিদর্শন রয়েছে সেই সব লোকের জন্য যারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা রূম: ২১) জীবনকে দুনিয়া ও আখিরাতে সুখী ও সাফল্যময় করার বহুবিধ উপকার নবীজি সা.এর ছোটবড় প্রতিটি সুন্নতেই রয়েছে

ফরজ-ওয়াজিব নয়-এই বিবেচনায় অনেকেই সুন্নতকে গুরুত্বহীন মনে করেআসলে সুন্নতের হাকীকত ও তাৎপর্য সম্পর্ক অজ্ঞতাই এহেন চিন্তার মূল কারণমানুষকে আল্লাহপাক আশরাফুল মাখলুকাত বানিয়েছেনকুরআনের ভাষায় অর্থ: আর অবশ্যই আদম সন্তানকে আমি মর্যাদা দান করেছি এবং তাদেরকে বাহন দান করেছি স্থলে ও জলভাগে, আর তাদেরকে রিজিক দান করেছি উত্তম সকল বস্তু হতে, আর তাদেরকে বিরাট শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি আমার বহু সৃষ্টির উপর। (সূরা বনি ইসরাঈল: ৭০) সুতরাং আশরাফুল মাখলুকাত হওয়ার দাবী এই যে, মানুষের রোজকার জীবন যাপনে যাবতীয় কাজকর্ম-আহার-নিদ্রা, জৈবিক চাহিদা পূরণ ইত্যাদি প্রাণী জগতের অন্য সবকিছুর চেয়ে সতন্ত্র হবেএই স্বাতন্ত্র আল্লাহপাক মানুষের কাছে আশা করেনযে তরীকা বা পদ্ধতি অবলম্বনে আশরাফুল মাখলুকাত নিজেদের স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা বজায় রাখবে তাই সুন্নতযা হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আল্লাহপাক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেনআল্লাহপাক বলেনÑ
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
অর্থ: বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ এমন ব্যক্তির জন্য, আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে। (সূরা আহযাব: ২১)

সাহাবা,তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনদের যুগে নবুওয়তি মিশনের চার কাজ সমাজে পরিপূর্ণ বাস্তবায়িত ছিলোআর এ কারণে ইসলামের ইতিহাসে সে তিন যুগ স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিতকিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, ধীরে-ধীরে উম্মত পেছনে সরে এসেছেনবুওয়তি মিশনের চার কাজের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করছেআর পরিণতিও যা হবার তাই হচ্ছেবর্তমান বিশ্বে মুসলমান গভীর সংকটাপন্ন, নির্যাতিত ও নিগৃহিতএহেন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের একটিই পথআমাদেরকে আবার নবুওয়তি মিশনের দিকে ফিরে আসতে হবেইমাম মালেক রহ. যথার্থই বলে গেছেন:-
الا أن آخر هذه الامة لا يصلح إلا
بما صلح به أولها

অর্থ: উম্মতের প্রথমাংশের সংশোধনের উপায় যা ছিলো তা-ই উম্মতের শেষাংশের সংশোধনের উপায়

 লেখক: মুফতী মানসুর আহমাদ


 প্রাবন্ধিক, মুহাদ্দিস ও খতিব

Comments