সর্বনাশা পাপের সর্বগ্রাসী শাস্তি



وعن عمرو بن العاص قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه و سلم يقول : ما من قوم يظهر فيهم الزنا إلا أخذوا بالسنة وما من قوم يظهر فيهم الرشا إلا أخذوا بالرعب  . رواه أحمد
অর্থ: হযরত আমর ইবনুল আস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে সম্প্রদায়ের মাঝে ব্যভিচার প্রকাশ্য রূপ পরিগ্রহ করে, নিশ্চিতভাবে তাদেরকে দুর্ভিক্ষের শিকারে পরিণত করা হয় আর যে সম্প্রদায়ের মাঝে ঘুষ প্রকাশ্য রূপ লাভ করে, তাদেরকে নিরাপত্তাহীনতায় পাকড়াও করা হয় (মুসনাদে আহমাদ, মেশকাত :৩১৩)
ব্যাখ্যা ও আনুষঙ্গিক কথা:
পাপ মাত্রই তা শাস্তিযোগ্য বিষয় অবশ্য কতক পাপ আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করে দেন পাপের চুড়ান্ত শাস্তি হবে আখিরাতে তথা কবরে, হাশরে, জাহান্নামে তবে কিছু পাপের শাস্তি দুনিয়াতেও কার্যকর করা হয়, মানুষকে সতর্ক করার জন্য পাপ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, মানুষের হস্তার্জিত পাপের কারণেই স্থলে ও জলে বিপর্য দেখা দিয়েছে তা তাদের কৃতকর্মের কিঞ্চিত স্বাদ আস্বাদন করানোর জন্য যেন তারা ফিরে আসে (সূরা রূম: ৪১)
পাপ অনুপাতেই পাপের শাস্তি পাপ যখন ব্যক্তির মাঝে সীমিত থাকে, শাস্তিও তখন কেবল ব্যক্তিকে ঘিরে আসে আর যখন তা সমাজে ব্যাপক ও প্রকাশ্য রূপ লাভ করে, শাস্তিও তখন সর্বগ্রাসী হয়ে আসে উক্ত হাদীসে দুটা পাপের জাগতিক শাস্তির কথা আলোচিত হয়েছে পাপ দুটাই বর্তমান সমাজে প্রকাশ্য রূপ পরিগ্রহ করে আছে আর এগুলোর শাস্তিও কার্যকর রয়েছে
প্রথম পাপ- ব্যভিচার: বর্তমান সময়ে ব্যভিচারের ব্যাপকতা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না একে এখন আর বিশেষ কোন পাপ জ্ঞান করা হচ্ছে না ক্ষেত্র বিশেষ বৈধতার লেবাস পরানো হচ্ছে বহু রকম আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় এর বাজারকে সরগরম রাখা হচ্ছে যার যৎসামান্যই নিম্নে তুলে ধরছি-
যিনা-ব্যভিচারের মতো জঘন্যতম পাপ কর্মটিকে মনুষ্য সমাজে সহজ ও হালকা করে তোলার জন্য পয়লা তদবির হলো বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার ব্যাপক অনুশীলন এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এগুলোতে অনৈতিক যৌন সম্পর্কের হীন বিষয়গুলোকে অতি স্বাভাবিক ও সহজ করে উপস্থাপন করা হচ্ছে পত্রিকার বিনোদন পাতায়, ম্যাগাজিনের কভার ফিচারে নগ্ন-অর্ধনগ্ন নারীর ছবি ও যৌন সুড়সড়িমূলক কথা ও গান পরিবেশন এখন নিতান্তই মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে বেহায়াপনা আর অশ্লীলতাকে সম্প্রতি বহুদূর এগিয়ে দিয়েছে এফ এম রেডিও এবং ইন্টারনেট যুবক-যুবতীদের যৌন উন্মাদনা যেন লাগামহীনভাবে বাড়ছে পাশ্চত্য থেকে আমদানি করা হয়েছে বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড ও ফ্রি-মাইন্ড কালচার এই চটকদার পরিভাষাগুলোর উদ্দেশ্য বিবাহ বর্হিভূত যৌনতাকে সমাজে অবাধ ও স্বাভাবিকতার সীমানায় নামিয়ে আনা। জন্ম নিয়ন্ত্রণের উপকরণসমূহের সহজ লভ্যতা এ ঘৃণ্য পথের পথিকদেরকে আরো বেপরোয়া বানিয়ে দিয়েছে
যিনা-ব্যভিচারকে ব্যাপক করার পেছনে বানিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিও কার্যকর অর্থের বিনিময়ে সম্ভ্রম বিক্রয়ের মতো বর্বর কর্মটিকে বৈধ করার জন্য এর নাম দেয়া হয়েছে-“সেক্সট্রেড বা সেক্স ওয়ার্ক এ পেশায়(!) নিয়োজিত নারীদেরকে বলা হচ্ছে সেক্সওয়ার্কার বা যৌনকর্মী অন্য দশ জন কাজের মানুষের মত এ সব নারীরাও তাদের চোখে বৈধ পেশাজীবি!
উল্লেখিত হাদীসে ব্যভিচারের শাস্তি:
যিনার পাপটি যখন গোপনীয়তার সীমা অতিক্রম করে প্রকাশ্য রূপ লাভ করে, তখন এর পাপীদেরকে আর অবকাশ দেওয়া হয় না এদের শাস্তিকে আখেরাত পর্যন্ত বিলম্বিত করা হয় না আখিরাতের আযাব যা হবার তা তো হবেই, দুনিয়াতেও নগদ কিছু প্রদান করা হয় এইডসের মতো মরণব্যাধি এ পাপেরই নগদ শাস্তি উক্ত হাদীসে যে শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো দুর্ভিক্ষ-খাদ্যাভাব এ দুর্ভিক্ষের বেশ কয়েকটি সুরত হতে পারে
প্রথম সুরত: উৎপাদন ও শস্যহানির কারণে আকাল দেখা দেয়া খাদ্যের ঘাটতি ও সংকট দেখা দেয়া
দ্বিতীয় সুরত: উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের বরকত ও উপকারিতা হ্রাস পাওয়া খাদ্যদ্রব্য বরকতশূন্য হওয়ার অর্থ হলো এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ পূর্ণরূপে বিদ্যমান না থাকা এবং তা অনিষ্ট সাধন করা আজকালের কোনো খাবারেই আগের মতো স্বাদ-ঘ্রাণ অবশিষ্ট নেই নানা জাতের মসলা ব্যবহার করে কোনরকম খাওয়ার উপযোগী করা হলেও খাবারের অনিষ্ট আজকাল বেড়ে গেছে খাবারগুলো আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে দূরের কথা, উল্টো নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
তৃতীয় সুরত: খাদ্যদ্রব্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মওজুদ থাকা সত্ত্বেও ব্যবহারে আনতে না পারা যেমনটা আজকাল আমরা দেখছি, দ্রব্যমূল্য দিন দিন লাগামহীনভাবে বাড়ছে মধ্যবিত্তরাও খেয়ে পরে বাঁচতে হিমশিম খাচ্চে এসবের বাহ্যিক কারণ যাই হোক, মূলত এগুলো আমাদের পাপেরই শাস্তি
দ্বিতীয় পাপ- ঘুষ:
ঘুষ সমাজ দেহের একটা মারাত্মক বিষফোঁড়া সমাজ দেহে পচন সৃষ্টি ও সমাজকে অচলাবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই একটি পাপই যথেষ্ট এটি বর্তমানে ভয়াবহরূপ পরিগ্রহ করে আছে ঘুষ গ্রহীতারা দাতাদের কাছ থেকে তা ন্যায্য পাওনার মতোই আদায় করে নিচ্ছে দেশের উচ্চ-গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ থেকে শুরু করে নিম্ন-সাধারণ বিভাগ পর্যন্ত সবখানেই এর ব্যাপক চর্চা সব কিছুই ঘুষনির্ভর আর এ অভিশাপের নির্মম শিকার নিরীহ সাধারণ মানুষ
দুই শ্রেণীর লোক ঘুষকে অন্যায় বলে বুঝার পরও অবলীলায় তা গ্রহণ করে প্রথম শ্রেণী- যাদের আয় নিম্ন বা মধ্যম পর্যায়ের তাদের দাবী হলো, এই যৎসামান্য উপার্জন দিয়ে সংসার চালানো যায় না থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেই তারা বাধ্য হয়ে এ সুযোগ গ্রহণ করেন
ঈমান ও ইয়াকীনের দুর্বলতার কারণেই মনে এহেন চিন্তা ও যুক্তি স্থান পায় আল্লাহপাকরাযযাক’- রিযিকদাতা হালালের মাধ্যমেই তিনি প্রতিজন বান্দার জীবনের সব প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন বান্দা যখন আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান ও বিশ্বাস পোষণ করে, তাকে ভয় করে, আনুগত্য করে তখন তার উপার্জনে বরকত এসে যায় সামান্য উপার্জনও তখন তার জীবন যাপনের সব চাহিদা পূরণে যথেষ্ট হয় অপর দিকে যে আল্লাহর উপর আস্থা রাখতে পারে না, তার উপার্জন বরকত শূন্য হয় উপার্জন যত বেশি হয় ব্যয়ও তত বাড়তে থাকে অপ্রত্যাশিতভাবে সৃষ্টি হতে থাকে ব্যয়ের নতুন নতুন খাত আজ থানায় কিছু দিতে হয়, কাল সন্ত্রাসীদের চাঁদা আদায় করতে হয়, পরশু ছেলের এক্সিডেন্টে। নিয়মিত খরচ তো আছেই এত টাকার যোগান দিতে গিয়ে উন্মাদ হয়ে যেখানে যা পায় সব গোগ্রাসে গিলতে থাকে হালাল-হারামের তোয়াক্বা থাকে না তার কাছে ন্যায্য বেতন আর ঘুষের টাকা দুটোই সমান হয়ে যায়
আর দ্বিতীয় শ্রেণীটি হচ্ছে যারা অতি বিলাসী জীবনের হীন মানসিকতার শিকার বেতন ভাতা যাই হোক, বাড়ি-গাড়ীর আকাশ ছোয়া স্বপ্ন তারা দেখতে অভ্যস্থ এ স্বপ্ন পূরণের জন্য তো নির্দিষ্ট অংকের হালাল পয়সা যথেষ্ট নয় তাই তারা নিরুপায়(!)হয়েই তারা ঘুষ গ্রহণ করে থাকে
দ্বিতীয় পাপের শাস্তি: উল্লেখিত হাদীসে ঘুষের জাগতিক যে শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, যে সম্প্রদায়র মাঝে ঘুষ প্রকাশ্যরূপ পরিগ্রহ করে, আল্লাহ পাক সে সম্প্রদায়কে ভয়-ভীতি ও আতঙ্কগ্রস্থ করে দেন নিরাপত্তাবোধ তাদের থেকে ছিনিয়ে নেন জানের নিরাপত্তা থাকে না, মালের নিরাপত্তা থাকে না আমাদের বর্তমান বাস্তবতার দিকে থাকালে বুঝতে ভুল হয় না যে, আমরা এখন এ শাস্তির শিকার হয়ে আছি সমগ্র পৃথিবীতে ত্রাসের রাজত্ব সর্বত্র ভয়, শংকা, আতঙ্ক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে নিয়ে একজন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কারো জীবনে নিরাপত্তা নেই এ অবস্থার আদৌ পরির্বতন হবে না, যদি না আমরা এ পাপ বর্জন না করি
মোদ্দা কথা, উল্লিখিত দুটি সর্বনাশা পাপের কারণেই আমরা বর্তমানে সর্বগ্রাসী শাস্তির শিকার সমাজের এক শ্রেণীর পাপের কারণে সব শ্রেণীই আযাবের শিকার হয় এটাই আল্লাহর নিয়ম ইরশাদ হচ্ছে- আর তোমরা ঐ বিপর্যয়কে ভয় কর, যা বিশেষত: শুধু তাদের উপর পতিত হবে না, যারা তোমাদের মধ্যে যালেম এবং জেনে রেখ, আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠোর [সূরা আনফাল-২৫]

জীবনকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর সুখী করতে আমাদেরকে সব রকমের পাপ বর্জন করতে হবে সমাজকে পাপমুক্ত করতে সকলকেই সচেষ্ট হতে হবে আল্লাহপাক আমাদেরকে তাওফিক দান করুন আমীন।।
                                                                                                      
                                                                      [লিখেছেন - মুফতী মানসুর আহমাদ]

Comments

Post a Comment