[হযরত মুফতিয়ে আযম ফয়জুল্লাহ রাহ. ছিলেন বিগত শতাব্দীর শেষের দিকের এক অসাধারণ বরণীয় ব্যক্তিত্ব। যাঁর যাপিত জীবনে ইলম ও আমল ছিলো সমার্থক। ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রেই সুন্নত পালনের প্রতি যাঁর অনুরাগ ছিল অপরিসীম। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, সুন্নতের বিপরীত অবস্থান মানেই ধ্বংস। তাঁর গোটা জীবনটাই ছিল সমাজের সর্বস্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ ও উসওয়াহ তথা তাঁর সুন্দরতম আদর্শ প্রতিষ্ঠার নিষ্ঠাপূর্ণ নিরলস সংগ্রামের। তাঁর জীবনের সকল বয়ান, বক্তৃতা ও রচনাবলী ছিল প্রতিটি মানুষের সামগ্রিক জীবনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যে। জীবন সায়াহ্নে উপনীত হয়ে তিনি যাপিত পুরো জীবনের নির্যাস দিয়ে লিখে গেছেন এক সংক্ষিপ্ত সমৃদ্ধ অসিয়ত নামা।
উদ্দেশ্য মাদরাসা পড়ুয়া ওলামা-তলাবা, ইসলামের নিষ্ঠাবান সেবক ও কর্মী। সবার জন্য এ এক গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা। মূল অসিয়তটি ছিল ফারসী ভাষায়। মুহতারাম উস্তায মুফতি নূর আহমাদ দা.বার এর নির্দেশে (হিদায়া আখেরাইনের বছর)এর অনুবাদ করি। দারুল উলূম হাটহাজারী থেকে প্রকাশিত মাসিক মুঈনুল ইসলাম নভেম্বর-২০০০ইং সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়। এ বরকতপূর্ণ অনুবাদটিই অধমের স্বনামে ছাপা প্রথম লেখা। প্রায় সাড়ে চৌদ্দ বছর পর অনুবাদটি সামান্য পরিমার্জন করে আদদাওয়াহ-এর সম্মানিত পাঠকদের খিদমতে পেশ করছি।]
الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى- اما بعد
সকল
মুহিব্বীন ও হিতাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশ্যে অধমের অসিয়ত। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে এসে উপনীত হয়েছি। শরীরে একের পর রোগব্যাধি এসে ভিড় করছে। বার্ধক্য ও দুর্বলতাও পৌঁছেছে চরমে। মৃত্যুও হয়তো শিয়রে দাঁড়িয়ে। জানিনা কখন পরপারের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে হয়।
আমার
মৃত্যুকালে ও পরবর্তী সময়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সুন্নত পরিপন্থী কোন কার্যকলাপ যেন সংঘটিত না হয়। কবর হবে বগলি। কবরের ডান পার্শ্বে শুইয়ে মুখ ক্বিবলামুখী করে দেবে। অধমের জন্য ইস্তিগফার করবে। মাসনুন যিয়ারত করবে। কুরআন তিলাওয়াত বা অন্য কোন নেক আমলের সাওয়াব রেসানি করে অধমের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করবে। তবে এর জন্য কোন উদ্যোগ-আয়োজন থাকবে না। দিন-তারিখ নির্ধারিত হবে না। লোক সমাগম হবে না। হবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং একাকীভাবে।
মনে রাখতে হবে, যে সব
কাজে জামাতের কথা শরীয়তের বিধানে খুঁজে পাওয়া যায় না, সেসব কাজ সম্মিলিত ভাবে করা আদৌ উচিত নয়। এতে তা বিদআত ও গোনাহের কাজে পরিণত হয়। ইবাদত ও সওয়াবের কাজ থাকে না। সুতরাং এ ধরণের কাজ অনানুষ্ঠানিক ও অনাড়ম্বরভাবে করবে। কোন রকম লোক ডাকাডাকি ছাড়া প্রত্যেকে একা একা করবে। এমনটিই যুক্তিযু্ক্ত এবং শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকেও জরুরি।
সকল
কাজে কর্মে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণই মুখ্য উদ্দেশ্য হতে হবে। বিদআত ও শরীয়ত নিষিদ্ধ ক্রিয়া-কর্মের নিকটবর্তীও হওয়া যাবে না। এ ইয়াক্বীন ও বিশ্বাস পোষণ করবে যে, সকল বুযুর্গী ও কামালিয়্যাত, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব, কল্যাণ ও সাফল্য নবীজির আনীত শরীয়ত এবং তাঁর সুন্নাহর যথার্থ অনুসরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
এটা শেষ যুগ। ইসলামের দীনতা ও অসহায়ত্বের যুগ। নানান রকম বিদআত ও গর্হিত ক্রিয়াকর্ম প্রকাশ হওয়ার যুগ। এমন একটা সময়ের কথা হাদীস শরীফে এভাবে এসেছে- “ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে দৈন্যবেশে। পরিশেষে প্রত্যাবর্তন করবে সেই আগমনকালীন বেশে।” আল্লাহর দ্বীনের আজ এমন কোনো বিষয় ও শাখা অবশিষ্ট নেই, যেখানে প্রচুর পরিমাণে অতিশয় মন্দের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কেবল ইসলামের নামটাই বাকি আছে। হাকীকত ও মৌলিকত্ব উধাও হয়ে গেছে। এহেন সময়ের কথা উল্লেখ করেই হাদীসে বলা হয়েছে- “মানুষের উপর এমন এক সময় উপস্থিত হবে, যখন ইসলামের নাম ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। কুরআন পাঠের শুধু রেওয়াজই বাকি থাকবে। মসজিদসমূহ সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা হবে, কিন্তু হবে হিদায়াত শূন্য। আলেম পরিচয়ধারী একটা সম্প্রদায়ই হবে আকাশ গাত্রের নিচে সর্বাধিক নিকৃষ্ট জীব। তাদের থেকে ফিতনা বের হবে এবং তাদের দিকেই ফিরবে।”
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ. এর এ সত্যভাষণ আজ একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে- “এ যুগের কথিত আলেমরাই সকল প্রকার বিদআতের প্রবর্তক এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহসমূহের ঘাতক।” তিনি আরো বলেন- “শরীয়তের বিষয়াবলীতে যত গর্হিত ও মন্দ প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং যত ত্রুটি আল্লাহর দ্বীনের পূত-পবিত্র রীতি-নীতিতে প্রকাশ পেয়েছে, তার সবই এক শ্রেণীর নামধারী আলেমদের মতলবী চিন্তা ও আচারের ফসল”
পরিতাপের বিষয় হলো, এ সকল গর্হিত রীতি-নীতি ও বিদআতসমূহকে এ যুগের লোকেরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় বলে বিশ্বাস করেন। সাধারণ মানুষ তো আছেই, অনেক প্রথাগত আলেম এবং কোন কোন মহলের খাছ লোকেরাও এ ধারণা পোষণ করেন।। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ ও সোনালী যুগের সোনার মানুষদের সাদৃশ্য অবলম্বন তথা কুরআন ও হাদীসের নির্দেশিত পথে চলাকে আত্মশুদ্ধি ও বেলায়াতের পথে অপূর্ণাঙ্গ মনে করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
এই বহুমাত্রিক ফিতনা ও বিপর্যয়ের দিনকালে তারাই ভাগ্যবান- যারা হিম্মত ও সাহসিকতার সাথে কোমর বেঁধে দ্বীন ইসলামের বেদনা বুকে নিয়ে, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি করুণা ও সহানুভূতি অন্তরে ধারণ করে আল্লাহর উপর ভরসা করে বিশুদ্ধ নিয়তে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যে এবং সমাজের সর্বস্তরে নবীজির সুন্নাহ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত রাখবে। সর্ব প্রকার বিদআত, কুসংস্কার ও পাপের কবর রচনায় নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একখানা হাদীসে এদের প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে-“সুসংবাদ ঐ সকল বিরল ব্যক্তিদের জন্য, যারা আমার ঐসব সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করবে, যেগুলো আমার তিরোধানের পর মানুষ বিকৃত করে ফেলেছে।” অন্য এক হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-“যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে জীবিত করবে, সে যেন আমাকেই জীবিত করলো।”
সর্বদা কুরআন ও হাদীসের আলোকে কথা বলাকে অভ্যাসে পরিণত করবে। মধুর সুরে কবিতা (শে’র) পাঠ, গজল গাওয়া, বাজে কথা বলা ও গল্প-কৌতুক করা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নোক্ত হাদীসে বর্ণিত সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে- “হে আল্লাহ! আমার স্থলাভিষিক্তদের প্রতি সদয় হোন। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার স্থলাভিষিক্ত কারা? জবাবে বললেন, যারা আমার পরে আগমন করবে, আমার হাদীস বর্ণনা করবে এবং লোকজনকে শিক্ষা দেবে।” অপর এক হাদীসে রাসূল সা. বলেন-“আল্লাহ পাক সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রাখুন ঐ সকল ব্যক্তিকে যারা আমার উক্তিকে শ্রবণ করে, অতঃপর যথাযথ মর্যাদার সাথে হিফাযত করে। অতঃপর যেমন শুনেছে হুবহু অন্যের নিকট পৌঁছে দেয়।” রাসূল সা. এর যোগ্য প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হতে পারাটা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদা ও পরম সৌভাগ্যের বিষয়।
কিন্তু শত সহস্র আফসোস! মানুষ আজ অঢেল বিত্তবৈভব ও উচ্চ পদাধিকারীদের প্রতিনিধিত্ব গ্রহণে লালায়িত ও প্রণায়াসক্ত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লামের প্রতিনিধিত্ব অর্জন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার প্রতি কোনই ভ্রুক্ষেপ নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
ভাষান্তর: মুফতী মানসুর আহমাদ
Comments
Post a Comment